BANGLA বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জিরো ড্রাফট চুক্তি:

         ভারতের প্রতিক্রিয়া কি হতে চলেছে?

                

                 -      ডঃ বীণা রাঘব

গত তিন বছরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নাম ভারতের আম জনতার কাছে অপরিচিত ছিল না। তার আগে এই সংস্থাটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এত বেশি কৌতুহলী এবং ওয়াকিবহাল ছিলেন না। আশ্চর্যের বিষয়, গত তিন বছরে এই আন্তর্জাতিক সংস্থাটি বিশ্বমঞ্চে এমন একটি কেন্দ্রীয় অবস্থান দখল করেছে যার মাধ্যমে সমস্ত পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করতে পারছে। তা সে লকডাউন হোক কিংবা সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক অথবা ভ্যাকসিন, যাইহোক না, সমস্ত ক্ষেত্রেই এই সংস্থাটি নানান নির্দেশ ও নিয়মাবলী জারি করেছে , কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, যা প্রায় সব দেশ ই লাগু করেছে। বর্তমানে এই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্ষেপে হু একটি মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছে। সেটি হল জিরো ড্রাফ্ট শিরোনামে একটি খসড়া চুক্তি সম্পাদন করা এবং পৃথিবীর ১৯৪ টি দেশকে সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা। এখন প্রশ্ন হল এসবের মানেটা কি? একজন সাধারণ মানুষ, রোগী কিংবা চিকিৎসক যেই হোন তাদের কাছে এই চুক্তি কি অর্থ বহন করে?

 

আসুন, প্রথমে এক ঝলক ইতিহাসের দিকে চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রপুঞ্জের একটি শাখা সংগঠন হিসেবে হু এর জন্ম হয়েছিল। তখন ঘোষিত লক্ষ্য ছিল, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির মাধ্যমে রোগ সংক্রমণ প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে সদস্য দেশগুলোতে সহায়তা করা।

বিগত কয়েকটি দশকে, হু’ অনেক বেশি জড়িয়ে পড়েছে বেসরকারি বিভিন্ন স্বার্থের সঙ্গে। মুনাফা কেন্দ্রিক ঐসব গোষ্ঠীর সঙ্গে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ গড়ে তুলতে হু  খুব অনেক বেশি  তৎপর ছিল। তার ই ফল হিসেবে গাভী ( গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস এন্ড ইমিউনাইজেশন) এবং সেপি ( কোয়ালিশন ফর এপি ডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস এন্ড ইনোভেশন) এইরকম সংস্থাগুলির সঙ্গে গাট ছড়া বেধেছে  হু’। এইসব ক্রিয়াকলাপ গত তিন বছরে একটি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। তার ই পরিণতি হিসেবে আমরা পেয়েছি প্যান্ডেমিকের বিধিনিষেধ এবং জবরদস্তি টিকাকরণের মত নিদান। কাজেই হু’ মূলত একটি আমলাতান্ত্রিক সংগঠন এবং এখানে সব বিষয়ে সবচেয়ে পন্ডিত এবং শ্রেষ্ঠ চিকিৎসকরা নিদান দেন, এমনটা ভেবে নেবার কোন কারণ নেই।

এবার দেখে নেওয়া যাক কিভাবে বদলে যাচ্ছে হু’ এর চরিত্র। প্রথমত: বিগত তিন বছরে, 'সকলের জন্য একই মাপের জামা' এই নীতি হয়ে উঠেছে হু এর প্রস্তাবিত প্রায় সমস্ত নির্দেশ এবং কর্মসূচির প্রধান ভিত্তি। এটা ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে সদস্য দেশগুলি এক একটি স্বতন্ত্র এবং সার্বভৌম দেশের জাতীয় সরকার। তারা  শুধুমাত্র কোন স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক সংগঠন নয়। এই ভ্রান্তির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেসরকারি মুনাফা কেন্দ্রিক ওষুধ ও স্বাস্থ্য বাণিজ্যের আবশ্যিকতা। জনস্বাস্থ্যে এইসব কায়েমী স্বার্থের উপস্থিতি জনজীবনের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে কিভাবে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে সে সম্পর্কে আমেরিকান জার্নাল অফ পাবলিক হেলথ পত্রিকায় ২০১৬ সালে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে,  “হু'এর পরিচালন পদ্ধতি এবং অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা নিয়ে বহু প্রশ্ন আছে। প্রায় চার বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ হু'এর অর্ধ বর্ষের বাজেটের ৮০ শতাংশের জন্য অর্থদাতাদের বদান্যতার উপর নির্ভর করতে হয়। এই কারণে স্বতন্ত্র ভাবে নীতি নির্ধারণের পরিবর্তে অর্থদাতাদের দেখানো পথেই চলতে হয়।“

এই পরিপ্রেক্ষিতে যখন আন্তর্জাতিক চুক্তির জন্য হু'এর এই অতি তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তখন স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠা উচিত এই চুক্তি কাদের স্বার্থে? এবং আমাদের মত সাধারন জনগণের কাছে এই  চুক্তির তাৎপর্যই বা কি?

মাস্কের ব্যবহার কিংবা সার্বজনীন টিকা- সব ক্ষেত্রে এটা ধরেই নেওয়া হয়েছে যে হু যে সমস্ত নিদান দিয়েছে সেসব প্রশ্ন এবং সমালোচনার ঊর্ধ্বে। একমাত্র যে প্রশ্নটি করা যেতে পারে সেটা হচ্ছে কিভাবে হু এর নিদান কার্যকর করা হবে?

একইভাবে কোন পাল্টা প্রশ্ন বা বিতর্কের জায়গা না রেখেই প্রস্তাবিত চুক্তির জিরো ড্রাফ্টে কিছু বাধ্যতামূলক অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন-

১. সদস্য দেশগুলোকে( ওষুধ, চিকিৎসা-সরঞ্জাম ও টিকা) সরবরাহ সুনিশ্চিত করার জন্য পরিকাঠামো উন্নত করতে হবে। ( আর্টিকেল ৬)

২. সদস্য দেশগুলোকে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং প্রয়োজনে পেটেন্টের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।( আর্টিকেল ৭)

৩. সদস্য দেশগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের স্থানীয় আইনকানুন যেন আন্তর্জাতিক আইনের অনুসারী হয়।( আর্টিকেল ৮)

৪. সদস্য দেশগুলোকে নকল ওষুধ, টিকা বা যেকোনো স্বাস্থ্য পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে( আর্টিকেল ৮)

৫. সদস্য দেশগুলোকে ভ্যাকসিন ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে (আর্টিকেল ৯)

৬. সদস্য দেশগুলোকে সেন্সর শীপ চালু করতে হবে (আর্টিকেল ১৭)

৭. সমস্ত সদস্য দেশগুলোকে তাদের স্বাস্থ্য বাজেটের পাঁচ শতাংশ প্যান্ডেমিকের জন্য খরচ করতে হবে। (আর্টিকেল ১৯)

 

প্রস্তাবিত চুক্তিতে ছড়িয়ে আছে এরকম অসংখ্য ‘কি করিতে হইবে’ জাতীয় অঙ্গীকার। মজার বিষয় হচ্ছে, ঠিক উল্টো সুরে আবার সেখানে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপুঞ্জের সনদ এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্রতিটি সদস্য দেশের সার্বভৌম অধিকার রয়েছে তাদের নিজ নিজ জনস্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করা এবং তাকে পরিচালনা করা। মহামারী প্রতিরোধ এবং তাকে মোকাবিলা করার প্রস্তুতি সবকিছুই করতে হবে তাদের নিজস্ব রাষ্ট্রীয় নীতি এবং আইনি ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে।‘

অন্যভাবে বললে বিষয়টা এই দাঁড়ায় যে, একবার তুমি যদি চুক্তিতে সই করো, তুমি তোমার ইচ্ছা অনুযায়ী চলতে পারবে ; তবে ততক্ষণই পারবে যতক্ষণ আমি সেটা চাইবো। পছন্দের স্বাধীনতা বলতে শুধু এটাই হয়তো থাকতে পারে। এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহা নির্দেশক তার মর্জি-মাফিক কোন অসুখকে প্যান্ডেমিক ঘোষণা করতে পারেন। ঠিক যেমন হু এর প্রধান, তেদরস আধানম ঘেব্রেসিয়াস মাংকি পক্সকে জনসাস্থের মহা বিপদ বলে ঘোষণা করেছিল ,যদিও তার এই মতের বিপক্ষে ৯টি ভোট এবং পক্ষে ৬ টি ভোট ছিল।

মোটের উপর আন্তর্জাতিক প্যান্ডেমিক চুক্তির মাধ্যমে এমন একটি ব্যবস্থাপনা সৃষ্টি করা হচ্ছে যার মাধ্যমে কোভিড কালে যেসব ধ্বংসাত্মক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল সেগুলো যাতে আরও দক্ষতার সঙ্গে নেওয়া যেতে পারে। সেই সময় এমন একটি সর্বব্যাপী আতঙ্কের বাতাবরণ তৈরি করা হয়েছিল যার ফল স্বরূপ দেশের একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও হু এর বিধি নিষেধ কার্যকর করা সম্ভব হয়েছিল। সংকটকালে মানুষ ক্ষমতাকে আঁকড়ে ধরে উত্তরণের পথ খোঁজার চেষ্টা করে। এমনকি, এমন সব সংস্থাকে মানুষ স্বেচ্ছায় চূড়ান্ত ক্ষমতা দিয়ে দেয় যাদের আসলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। জবরদস্তি পরীক্ষা-নিরীক্ষা, চিকিৎসা এমনকি টিকা দেওয়া পর্যন্ত জনমানুষে একটি স্বীকৃত পদ্ধতি হয়ে উঠেছিল। এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল যেখানে হয় আপনি টিকা নেবেন না হলে আপনাকে অসামাজিক ভাবা হবে এবং আপনাকে তার জন্য শাস্তি পেতে হবে। সেই ভ্যাকসিনের বন্টন ব্যবস্থায় নাকি অসাম্য রয়েছে এমন একটি ছেদো যুক্তি সামনে রেখে এই প্যান্ডেমিক চুক্তিকে সামনে আনা হচ্ছে। এটা বলার মানে হচ্ছে হাতুড়িটা সকলকে একসাথে আঘাত করার জন্য সমান মাপের নয় , তাই সেটিকে আরও বড় এবং আরো শক্তিশালী করতে হবে।

 

এই চুক্তির ফলে যে সুবিধে হবে সেটা হচ্ছে ভবিষ্যতে হু এর বিধি-নিয়ম কার্যকর করতে হলে বারবার আতঙ্কের আবহাওয়া সৃষ্টি করার প্রয়োজন নেই। আতঙ্ক এবং তাকে ভিত্তি করে একটি আমলা তান্ত্রিক স্বাস্থ্যভিত্তিক শাসনব্যবস্থা পাকাপাকিভাবে গড়ে উঠবে এবং অবশ্যই সেটা হবে জনগণের করের টাকায়। এক কথায় বলা যেতে পারে গোটা পৃথিবীটাকে একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রিক কারাগারে পরিণত করা হবে যেখানে থাকবে ১৯৪ টি কুঠুরি। প্রতিটি কুঠুরিতে একেকটি দেশের সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীনতা বন্দী হয়ে থাকবে। সেই কারাগারের পাহারাদার হবেন হু এর বর্তমান মহা নির্দেশক। চুক্তিতে আসলে লেখা থাকবে কোন কুঠুরি কতটা বিস্তৃত হবে এবং কোন কুঠুরির দরজা কখন খুলবে বা বন্ধ হবে। সব মিলিয়ে স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক স্বৈরাচারের চিত্রনাট্য লেখা থাকবে এই চুক্তিতে। এবং আমরা ভাবতে বাধ্য হব যে আমরা স্বাস্থ্যের দিক থেকে অত্যন্ত নিরাপদ বলয়ের মধ্যে রয়েছি।

হু এর সঙ্গে মোদি সরকারের সখ্যতা এবং উৎকট ঘনিষ্ঠতা প্রমাণ করছে তাদের সঙ্গে আমাদের দেশের বন্ধন আরো বেশি শক্তিশালী হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রদর্শনী এমন একটি জায়গায় গিয়েছে যেখানে মোদি , হু’ এর প্রধান তেদ্রস কে তুলসী ভাই নামে অভিহিত করছেন।

সেই কারণেই আমাদের দেশের প্রতিটি চিন্তাশীল এবং স্বাধীনচেতা মানুষের কর্তব্য হচ্ছে এই চুক্তির বিষয়ে সত্য কথাগুলোকে স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করা এবং জনস্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত সমস্ত চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য কর্মীদের এমন একটি মঞ্চে ঐক্যবদ্ধ করা যা হবে হু এর প্রভাব থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। যেখানে থাকবে না সবাইকে এক মাপের জামা পরানোর বাধ্যবাধকতা। যেখানে থাকবে না সেই সব ধনুকবেরদের আধিপত্য যারা মানবতার বিরুদ্ধে ভয়ংকর অপরাধ করেছে এবং গুনাগার দিয়েছে। এর বিপরীতে প্রস্তাবিত জনস্বাস্থ্যের মঞ্চ হবে সম্পূর্ণভাবে জনস্বাস্থ্যের জন্যই নিবেদিত এবং সেটার যোগাযোগ থাকবে সমাজের একেবারে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত। এই লক্ষ্যেই ইউনিভার্সাল হেলথ অর্গানাইজেশন গড়ে তোলা ছিল প্রথম পদক্ষেপ। আমি সকলের কাছেই আবেদন করব এমন ধরনের আরো অনেক সংগঠন গড়ে উঠুক এবং তাদের মধ্যে সহযোগিতার সেতু বন্ধন তৈরি হোক যা প্রকৃত অর্থেই জনস্বাস্থ্যের উপযোগী সমস্যা সমাধানের নতুন রাস্তা খুলে দিতে পারে।

                      বাংলা অনুবাদ ঃ ড. গৌতম দাস


লেখক পরিচিতিঃ

 লেখিকা ডঃ বীণা রাঘব তিনি মাদ্রাজ মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন এবং ব্যাঙ্গালোর মেডিকেল কলেজ থেকে অ্যানাস্থাশিয়াতে ডিপ্লোমা অর্জন করেছেন। গত কুড়ি বছর ধরে তিনি অ্যানাস্থেসিওলজিস্ট হিসেবে কাজ করে গেছেন। বাঙ্গালোরে চিকিৎসক দম্পতি হিসেবে তারা ক্লিনিকাল নিউট্রিশন এবং অ্যান্থ্রোপোসফিক্যাল মেডিসিন প্র্যাকটিস করেন। তিনি ইউনিভার্সাল হেলথ অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্যা।

Comments

Popular posts from this blog