BANGLA
জনস্বাস্থ্য বিপন্ন হলেই পুঁজির মুনাফা ও পুলিশি শাসন?
- ডঃ অমিতাভ ব্যানার্জী
একটি কাল্পনিক দৃশ্য দিয়ে শুরু করছি। মনে করুন কোন রোগীর হাত পা বেঁধে
তার মাথার খুলিতে গর্ত করা হচ্ছে, যাতে তার দেহ থেকে অপশক্তি বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে।
এই প্রথাটির নাম ছিল ট্রেফাইনিং। এবারে মনে করুন, এইরকম রোগীদের জবরদস্তি করে, তাদের
নিজেদের বা তাদের আত্মীয়দের সম্মতি না নিয়েই তাদের দেহে কোন পরীক্ষামূলক ওষুধ ইনজেকশন
মারফত ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসবই করা হচ্ছে মানবজাতির স্বার্থে, না হলে এই রোগীরা
অন্যের ক্ষতির কারণ হতে পারত।
এই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি সভ্যতার আদিম যুগে বেশ প্রচলিত ছিল। কিন্তু আজকের
দিনে এসব ঘটলে বড় রকমের নীতিগত ইস্যু হতে পারে কিংবা জনমানসে তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে
পারে।
সে যাই হোক, সাম্প্রতিক অতি-মারির কালে, এর থেকেও অনেক বড় ধরনের মানবাধিকার
লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে এবং সেগুলির পিছনে মূল কারণ ছিল ভয় এবং আতঙ্ক থেকে উদ্ভূত সরকারি
পদক্ষেপ। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই ক্ষেত্রে জনমানসে সেভাবে কোন হট্টগোল দেখা যায়নি। কোভিড
১৯ অতিমারির শুরু থেকেই এমন সব কঠোর স্বাস্থ্য বিধি চালু করা হয়েছিল যা সভ্যতার আদিম
পর্বেও দেখা যায়নি। এমনকি, অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের আগে প্লেগ কিংবা টিকা চালু
হওয়ার আগে গুটি-বসন্ত যখন এতটাই প্রাণঘাতী ছিল যে তাতে মৃত্যুর সম্ভাবনা ছিল প্রায়
চল্লিশ শতাংশ, তখনকার দিনেও এমন কঠোরতম নিষেধ কখনো কার্যকর হয়নি।
কিন্তু কোভিড এর মত অসুখে যেখানে মৃত্যুহার মাত্র ০.১% থেকে ০.৩%, সেই অসুখের
ক্ষেত্রেও কঠোর দমনমূলক প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কোভিড এর বিরুদ্ধে যেসব
ভ্যাকসিন অনুমোদন পেয়েছিল সেগুলো শুধু যে সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়নি তা নয়,
সেগুলো আদতে ছিল পরীক্ষামূলক টিকা যেগুলোর সুদূরপ্রসারী ক্ষতিকর প্রভাব নিশ্চিত ভাবে
জানা ছিল না। ভ্যাকসিন নিয়ে যাদের সংশয় ছিল তাদের চোখ রাঙানো, জনসমক্ষে হেও প্রতিপন্ন
করা এবং কলঙ্কিত করাই ছিল অন্যতম লক্ষ্য। তবে সাম্প্রতিককালে সুপ্রিম কোর্টের একটি
রায়, বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের ক্রমক্ষীয়মান আস্থা কে অনেকটাই পুনরুদ্ধার করেছে।
সুপ্রিম কোর্ট তাদের রায়ে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে ভ্যাকসিন কোনমতেই বাধ্যতামূলক
করা যাবে না এবং টিকা যুক্ত বা টিকা বর্জিত এই নীতির ভিত্তিতে জনগণের মধ্যে কোন বিভেদ
তৈরি করা চলবে না।
তবে, আগামী দিনে আমাদের ভাগ্য এতটা প্রসন্ন নাও হতে পারে। একবার যদি বহু
বিতর্কিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রস্তাবিত প্যান্ডেমিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে যায়
এবং ভারত সরকারের প্রস্তাবিত জনস্বাস্থ্য বিল বাস্তবায়িত হয়, সে ক্ষেত্রে আমাদের
আশংকার যথেষ্ট কারণ আছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সংক্ষেপে হু ভবিষ্যতের অতি-মারি মোকাবিলার
জন্য প্রতিরোধ, প্রস্তুতি এবং পদক্ষেপের দিশা ঠিক করতে একটি আন্তর্জাতিক স্তরে চুক্তির
দিকে এগোচ্ছে। এই প্রস্তাবিত চুক্তিতে জন-স্বাস্থ্যের সমস্ত নীতি ও নিয়মকে জলাঞ্জলি
দেওয়া হয়েছে।
ডক্টর ডেভিড বেল যিনি হু এর প্রাক্তন বিজ্ঞানী ছিলেন তিনি আমাদের সতর্ক
করে দিয়ে বলেছেন এই প্যান্ডেমিক চুক্তি ভবিষ্যতে বারবার লকডাউনের পরিস্থিতি সৃষ্টি
করবে এবং স্বাক্ষরকারী সমস্ত দেশের সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করবে।
তিনি বিশেষ জোর দিয়ে বলেছেন, “কোন দেশের সার্বভৌমত্বকে এই চুক্তি সরাসরি
আঘাত না করলেও সেই সব দেশের নিজ নিজ স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেবার অধিকার
কেড়ে নেবে এই চুক্তি”। তিনি আরো বলেছেন যে “হু এর এই প্রস্তাব আসলে এমন একটি আমলাতন্ত্রের
সৃষ্টি করবে যাদের অস্তিত্ব টিকে থাকবে এই প্যান্ডেমিক এর ওপর। অতিমারি বা সম্ভাব্য
অতিমারি ঘোষণার সঙ্গে এদের কায়েমি স্বার্থ আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকবে। অতি মারি যত
দীর্ঘস্থায়ী হবে ততোই এদের প্রাসঙ্গিকতা এবং দাপট বজায় থাকবে। সব দেখে শুনে মনে হচ্ছে,
অতিমারি মোকাবিলার পদক্ষেপ হিসেবে লকডাউন একটি চিরস্থায়ী কৌশল হিসেবে স্বীকৃত হতে
যাচ্ছে”।
অতীতে এর আগে বহুবার দেখা গেছে ‘হু’ যেসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেগুলো সরাসরি
ভাবে কোন না কোন কর্পোরেট গোষ্ঠী দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
ডক্টর বেল তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের সুরে বলেছেন, “এদের নীতিটা হচ্ছে, তুমি যদি
শেয়ারহোল্ডারদের সর্বোচ্চ মূল্য ফেরত দিতে চাও এবং তোমার যদি কোন ফার্মাসিউটিক্যাল
কোম্পানি থাকে, তবে কোন অসুখের বিরুদ্ধে স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতায় কত লোক সেরে উঠছে
সেদিকে নজর দেবার কোন দরকার নেই। তুমি বরং অনেক বেশি মনোযোগ দাও লোকেরা যে অসুখে ভুগছে
তাকে লক্ষ্য করে কতটা বিক্রি বাড়াতে পারো”।
ভারতবর্ষের মতো দেশের ক্ষেত্রে যেখানে চিকিৎসাযোগ্য এবং প্রতিরোধ যোগ্য
এন্ডেমিক সংক্রামক অসুখের ব্যাপকতা অনেক বেশি এবং উদীয়মান ভাইরাল অসুখের থেকে যেগুলি
অনেক বেশি প্রাণঘাতী, সেসব মোকাবিলার জন্য আমাদের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার সমস্ত স্বাধীন
ক্ষমতা যদি হু এর পায়ে সমর্পণ করা হয়, তবে এ কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় হু এর মত
একটি সন্দেহজনক এবং কুখ্যাত আন্তর্জাতিক সংস্থার মর্জি মাফিক নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জনস্বাস্থ্য
নীতিকে বেঁধে ফেলা হবে আমাদের দেশের পক্ষে আত্মহত্যার সামিল।
এই প্রস্তাবিত প্যান্ডেমিক চুক্তি'র মাধ্যমে একদিকে যেমন স্বাধীন রাষ্ট্রগুলির
সার্বভৌমত্ব কেড়ে নিতে উদ্যত হয়েছে হু, অন্যদিকে সংসদের বাদল অধিবেশনে জনস্বাস্থ্য
বিল ২০২২ আনার চেষ্টা চলছে।** এই কারণেই আমাদের শরীরের প্রতি আমাদের সহজাত অধিকার এবং
মানবিক অধিকার লঙ্ঘনের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। প্রস্তাবিত এই বিল নাৎসি সময়ের কথা মনে
করিয়ে দিচ্ছে যখন চিকিৎসা এবং গবেষণার নামে এমন সব বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছিল যার জন্য
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শুরু হয়েছিল নুরেমবার্গ ট্রায়াল।
এই প্রস্তাবিত বিলের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভাবনার জায়গা হল, চীনে আমরা যেরকম
দেখেছি, ঠিক সেই রকম কায়দায় জনস্বাস্থ্য রক্ষার নামে পুলিশ এবং রাষ্ট্রকে অতিমাত্রায়
ক্ষমতা দিয়ে দেওয়া। নাগরিকের মৌলিক অধিকার এবং তাদের নিজেদের দেহের উপর স্বতন্ত্র
সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার- এসব নস্যাৎ করে নানা ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতিকে বাধ্যতামূলক
করা হতে পারে, ব্যক্তিগত বা সাধারণ পরিসরে রাষ্ট্রের পাহারাদাররা ঢুকে পড়তে পারে,
জবরদস্তি করে কাউকে কোয়ারেন্টাইন বা বিচ্ছিন্নবাসে পাঠানো যেতে পারে কিংবা এর থেকেও
আরো কঠোর এবং নির্মম ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে, যদি রাষ্ট্র মনে করে কোন অঞ্চলে অতিমারি
এসেছে বা অতিমারি আসার সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে। এসবই করা হবে মানব সমাজের বৃহত্তম অংশের
স্বার্থ রক্ষার কথা বলে।
পুলিশ এবং আমলাতন্ত্রের কাছে জনগণ অসহায় ভাবে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হবে, কারণ ধরেই নেয়া হবে রাষ্ট্রের পাহারাদাররা যত স্বেচ্ছাচারী কাজই করুন না কেন তারা
সবই রাষ্ট্র এবং সমাজের প্রতি পবিত্র বিশ্বাসেই করছেন। কাজেই তারা থাকবেন সমস্ত রকম
আইন-কানুন বা মামলা ও মোকদ্দমার উর্ধ্বে। সেই কারণেই মনে করা হচ্ছে হু এর প্রস্তাবিত
প্যান্ডেমিক চুক্তির সঙ্গে কোন দেশ অশুভ গাঁটছড়া বেঁধে ফেললে, চূড়ান্ত ক্ষমতার অপব্যবহার
অসম্ভব নয়।
আমরা আশা করতে পারি নাগরিক সমাজে এই প্রস্তাবিত বিল নিয়ে বিস্তারিতভাবে
বিতর্ক চলবে। এবং জন-স্বাস্থ্যের নীতি-নির্ধারক ও আইন বিশেষজ্ঞদের সুচিন্তিত মতামত
নেওয়া হবে এবং এই প্রক্রিয়াটা হতে হবে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক জাস্টিস চন্দ্রচূড়ের কথা থেকে আমরা কিছুটা অনুপ্রেরণা
পেতে পারি। তিনি বলেছিলেন, “ রাষ্ট্র মিথ্যা রটনা করতে পারে কিন্তু নাগরিকদের সর্বদা
কড়া নজর রাখতে হবে এবং তাদের কর্তব্য হবে এইসব মিথ্যা কে উন্মোচিত করা”।
- ভাষান্তরঃ ডঃ গৌতম দাস
[**মূল ইংরেজী লেখাটি
২০ জুন ২০২২, ন্যাশনাল হেরার্ড পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল]
ডক্টর অমিতাভ ব্যানার্জি
ভারতীয় সেনাবাহিনীতে ফিল্ড এপিডেমিওলজিস্ট বা সমীক্ষক মহামারীবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি বর্তমানে ডি ওয়াই পাতিল
মেডিকেল কলেজে, কমিউনিটি মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান। জনস্বাস্থ্য নিয়ে ইংরেজি ভাষায়
তিনি একজন সুপরিচিত লেখক এবং ন্যাশনাল হেরালড দৈনিকের নিয়মিত ভাষ্যকার। সাম্প্রতিককালে
বিভিন্ন মহলে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছে তার প্রকাশিত বই- কোভিড 19 প্যান্ডেমিক: আ থার্ড
আই।
Comments
Post a Comment