ভ্যাকসিন শর্তে ভিক্ষের টাকা
ব্রাজিলের লুলা’য়িত গরীব-কল্যাণ
লুই ইনাচিও লুলা দ্য সিলভা। সংক্ষেপে লুলা। তিন মাস আগের নির্বাচনে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সুতোয় ঝুলছিল। তার ঝুলিতে ৫০.৯% ভোট। বলসোনারোর ৪৯.১%। নির্বাচনী গণনায় কারচুপির অভিযোগে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। কর্পোরেট মিডিয়া এবং বামপন্থী ভাষ্যকাররা বলেছে, এরা সবাই দক্ষিণপন্থী বলসোনারোর লোক। [1] [2] [3] [4] [27]
মহা শক্তিধর রাষ্ট্রের প্রধান জো বাইডেন কিন্তু চোখ বন্ধ করে ভরসা করেছেন লুলাকে। অভিনন্দন বার্তায় তিনি বলেছিলেন, দক্ষিণপন্থাকে পরাস্ত করে ব্রাজিলে গণতন্ত্র ফিরছে এবং সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও দুর্নীতি মুক্ত নির্বাচনে লুলা জিতেছেন।[5] ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে লেখা হয়েছিল, লাতিন আমেরিকা যেভাবে বামপন্থার দিকে ঝুঁকছে সেই প্রবণতাকে আরো মজবুত করলেন লুলা। [6] টাইম ম্যাগাজিন তো আরো একধাপ এগিয়ে লুলার জয়কে শুধু ব্রাজিলের নয়, এই গ্রহের জয় বলে বর্ণনা করেছিল। [7] আমাদের দেশের বামপন্থী পত্রপত্রিকার বিজয় উল্লাস না হয় বাদই দিলাম। দ্য ইকোনমিক টাইমস লিখেছিল লুলার জয় বামপন্থার পুনর্জন্মকে নিশ্চিত করছে। [8] একদা বামঘেঁষা দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা উচ্ছ্বাস চাপতে না পেরে বলেই ফেলেছিল বাইডেন তো সিআইএ, অভ্যন্তরীণ প্রশাসন, এবং সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে লুলার পক্ষে এতটাই সমর্থন জারি রেখেছিল যাতে করে বলসোনারোর পক্ষে কোন সেনা অভুত্থান করা সম্ভব না হয়। [9] সবচেয়ে মজার এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ মন্তব্যটি ছিল এখানকার এক অতিবাম সংসদীয় দলের মুখপত্রে। তারা বলেছিল লুলার জন্য সাম্রাজ্যবাদীদের এই সমর্থন আসলে ব্রাজিলের আর্থ সামাজিক স্থায়িত্ব রক্ষা করার জন্যই।[10]
সাও-পালোর মেটাল কারখানার শ্রমিক বস্তি থেকে যাত্রা শুরু করে অর্ধশতক ধরে নানা রাজনৈতিক উত্থান ও পতনের শেষে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট পদে তৃতীয়বারের জন্য আসীন হয়েছেন তিনি। মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তুলে বলেছেন “এটা আসলে ব্রাজিলের ফেরা নিজের ছন্দে, এখন যুদ্ধের বদলে শান্তি, ঘৃণার বদলে ভালোবাসার পক্ষে আমাদের ক্লান্তিহীন ভাবে কাজ করে যেতে হবে। এখন ভয়ের পরিবেশের বদলে বিরাট সম্ভাবনার সূচনা হবে”। ৭৭ বছরের বর্ষীয়ান এই নেতার বাগ্মিতায় মন্ত্রমুগ্ধ হতেন কোটি কোটি দেশবাসী। আটের দশকের গোড়ায় মার্কিন প্রশাসনের মদতপুষ্ট সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রণী নেতা ছিলেন তিনি। আজ সেই মার্কিন দেশের প্রেসিডেন্ট তার নির্বাচনে জয় কে দক্ষিণ পন্থার বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জয় বলে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন। প্রেসিডেন্ট লুলা এই সপ্তাহে মার্কিন দেশের সফরে গিয়ে এমন সব চমৎকার কথা বলছেন,তাতে আনন্দে উদ্বেলিত হচ্ছে হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র এবং তাঁবড় সংবাদ মাধ্যম। তিনি দেখা করবেন র্যাডিক্যাল লেফট অর্থাৎ অতিবাম নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। বাইডেন এবং বার্নই স্যান্ডারস দুজনের সঙ্গেই তার কথা হবে আমাজন ফান্ড নিয়ে। কি মনে হচ্ছে? পাথরের সোনার বাটিতে কর্পোরেট পূঁজি, গণতন্ত্র, এবং সাম্যের অলৌকিক মেলবন্ধন ঘটছে? নাকি ওটা ভাবের ঘরে মজে থাকার কারণে এক-ধরনের দৃষ্টি বিভ্রম?
লুলা এখন বিচক্ষণ এবং ধুরন্ধর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।দৃশ্যত তার কোন আদর্শগত বিভ্রম নেই। থাকলে রাজনৈতিক পুনর্জীবন লাভ করা অসম্ভব ছিল। তিনি জানেন ওয়াল স্ট্রিটের শক্তিধর ধন-কুবেররা ঠিক কি শুনতে চায়? [11]
ভোটের প্রচারে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে লুলার অভিযোগ ছিল তিনি ব্রাজিলকে সারা পৃথিবীর থেকে এক ঘরে করে রেখেছেন অর্থাৎ বিদেশী পুজি বেশি উৎসাহ দেখাচ্ছেনা। সেই জন্যই তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন রাষ্ট্রীয় তেল সংস্থা পেট্রোবাস থেকে কর্মচারীদের পেনশন ফান্ড সর্বত্রই আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজির অবাধ বিচরণ হবে। তার নির্বাচনে জিতে আসার কয়েকদিন পরেই ফিন্যান্সিয়াল টাইমস লিখেছিল “ লুলার এই জয়ের কারণেই এবার আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের বন্ধ রাস্তা খুলে যাবে এবং বিপুল টাকার স্রোত বইতে থাকবে ব্রাজিলে”।[12]
বোলসনারো কে পরিবেশবাদীরা বলত ‘জঙ্গল খেকো’। স্থানীয় কাঠ মাফিয়া, খনিজ সম্পদের কারবারি, চাষবাস এবং পশু পালনের জন্য ছোট ও বড় তরফের অনুপ্রবেশকারী- এরা বলসোনারোর প্রশ্রয়ে আমাজনের জঙ্গল কে ধ্বংস করছে - এই ছিল লুলার প্রচার এবং তাতে কর্পোরেট মিডিয়া ও মার্কিন প্রশাসনের ছিল তুমুল সমর্থন। লুলা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ২০৩০ সালের মধ্যে জঙ্গল ধ্বংসের ঘটনা শূন্যের কাছে নিয়ে যাবেন এবং অবৈধ জঙ্গল মাফিয়াদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাবেন। সেটা অবশ্য তিনি শুরুও করে দিয়েছেন। [13] লুলা সূচতুর ভাবে যে সত্যকে আড়াল করে গেছেন সেটা হচ্ছে আটটি বৃহৎ আন্তর্জাতিক খনিজ উত্তোলনকারী বিদেশী সংস্থা আমাজন অঞ্চলে বিনিয়োগ করেছে ৫৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।যে বিশাল অঞ্চল জুড়ে এরা জঙ্গল ধ্বংস করে খনন কার্য চালাবার পরিকল্পনা নিয়েছে, আয়তনে সেটা ইংল্যান্ডের মত দেশকে ছাড়িয়ে যাবে।এদের মধ্যে রয়েছে ভেল, এ্যাংলো-আমেরিকান,বেলোসান, রিও-টিন্টো এবং এ্যাংলো গোল্ড এর মতো কুখ্যাত সব খনি কোম্পানি। এখানে সবচেয়ে বেশি টাকা ঢেলেছে ক্যাপিটাল গ্রুপ, ব্ল্যাক রক এবং ভ্যান-গার্ড এরমতো পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ এবং ক্ষমতাশালী বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান যারা ওয়াল স্ট্রিটের প্রধান খেলোয়াড় এবং ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পিছনে মূল শক্তি, কারণ পৃথিবীর সব প্রথম সারির ধন কুবেরদের টাকা বাজারে খাটায় এই তিনটি সংস্থা। এছাড়াও অন্যান্য বিনিয়োগকারীদের মধ্যে রয়েছে- ব্যাঙ্কো দ্য ব্রাসিল, ফ্রান্সের ক্রেডিট এগ্রিকোলে , জার্মানির কমারজ্ ব্যাঙ্ক, আমেরিকার সিটি ব্যাঙ্ক এবং ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা এবং জাপানের এস, এম, বি, সি ব্যাঙ্ক। এসব তথ্য সামনে নিয়ে এসেছে আমাজন ওয়াচ এবং আমাজনের স্থানীয় জনজাতিদের সংগঠন এ,পি,আই,বি।[14] তাঁরা প্রবল ভাবে লুলাকে নির্বাচনে সমর্থন করেছিল এবং তাঁরা দাবি করেছিল তাদের অধিকার রক্ষার জন্য একটি আলাদা মন্ত্রক গঠন করতে হবে।[15]
লুলা এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট এবং বারনি স্যান্ডারস এর সঙ্গে বসে শলা পরামর্শ করছেন কিভাবে আমেরিকা আরো বেশি করে আমাজন ফান্ডে টাকা ঢালতে পারে। আমাজনের অরণ্যকে অতি মুনাফার লোভে আসলে ধ্বংস করছে যে সমস্ত প্রবল শক্তিশালী কর্পোরেট গোষ্ঠী তাদের কুকর্ম কে ঢাকা দেবার জন্য এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে, বিশ্বের এই বৃহত্তম বৃষ্টি-অরণ্যে
নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ জোরদার করার জন্য তৈরি হয়েছে এই ১.৪ বিলিয়ন ডলারের আমাজন ফান্ড। এদের ঘোষিত লক্ষ্য হচ্ছে সবুজায়নের মাধ্যমে পৃথিবীর এই মূল্যবান অরণ্যভূমিকে বাঁচানো। অঘোষিত উদ্দেশ্য হচ্ছে স্থানীয় জনজাতিদের এবং মাফিয়া দের নির্মূল করে বৃহৎ আন্তর্জাতিক পুঁজির জন্য আমাজনকে একটি অভয়ারণ্যে পরিণত করা। সেই কারণেই তাদের মতে 'স্বল্প উৎপাদন ক্ষমতার পশুপালনই হচ্ছে আমাজনের জঙ্গল ধ্বংস হওয়ার মূল কারণ। নষ্ট হওয়া জঙ্গলের ৬২% দখল করে আছে পশুদের চারণ ভূমি। সয়াবিন চাষের ক্রমবিস্তার এই জঙ্গলকে আরো বিপদজনক করে তুলছে। বেড়ে চলেছে গ্রীন হাউজ গ্যাসের নির্গমন'।[16]
ভোটের লড়াইতে লুলার আরেকটি মস্ত বড় বাজি ছিল সরকারি অনুদান প্রকল্প বোলসা ফ্যামিলিয়া’ র সঙ্গে বাধ্যতামূলক ভ্যাকসিনের শর্ত জুড়ে দেওয়া। অর্থাৎ, গরিব কল্যাণের আড়ালে ভ্যাকসিনের বাজারকে প্রসারিত করা। নির্বাচনী প্রচারে তিনি বলতেন," ভ্যাকসিন নেবার ক্ষেত্রে তোমার টাকা আছে বা নেই সেটা বিচার্য নয়। আসল ব্যাপারটা হচ্ছে তুমি বাঁচতে চাও না মরতে চাও"।[17]
ঠিক বিপরীত অবস্থান নিয়েছিলেন বলসোনারো। তিনি বলেছিলেন ভ্যাকসিন যদি নিতে বাধ্য করা হয় তবে তিনি হবেন শেষতম লোক। তিনি ভ্যাকসিন পাসপোর্ট এর বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি কোন সরকারি অনুদান প্রকল্পের সঙ্গে ভ্যাকসিনকে জুড়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন না। তিনি ঘোষিতভাবেই ছিলেন কোভিড এবং তার ভ্যাকসিন এ অবিশ্বাসী। তিনি মনে করতেন ফাইজারের ভ্যাকসিন এতটাই পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তৈরি করবে যে মানুষের দৈহিক চরিত্র বদলে যাবে। তিনি বলতেন যদি কেউ ভ্যাকসিন নিতে না চায় তবে বিতর্কটা সেখানেই থেমে যাওয়া উচিত। কেন তিনি ভ্যাকসিন নেননি, এই প্রশ্নে তার স্পষ্ট জবাব ছিল, “নতুন যেসব সমীক্ষার ফল আসছে সেসব দেখে আমার মনে হয়েছে কারো শরীরে অ্যান্টিবডি থাকলে ভ্যাকসিন নেবার প্রয়োজন নেই। তাই আমার শরীরে যখন যথেষ্ট অ্যান্টিবডি রয়েছে তখন কি কারনে আমি ভ্যাকসিনে নিতে যাবো?”[18]
উন্নত দেশের তুলনায় অর্ধেক দামে ফাইজার ভ্যাকসিন বিক্রি করার জন্য অন্তত ৫৩ বার ই-মেইল পাঠিয়েছিল তার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দপ্তরে। এই ভ্যাকসিন কিনতে আনুমানিক সরকারি খরচ ছিল ব্রাজিলীয় মুদ্রায় ৪৪ বিলিয়ন ডলার।[19] প্রায় ছয় মাস পর্যন্ত ফাইজারের এই আগ্রাসী মার্কেটিং কে তিনি আটকে রাখতে পেরেছিলেন। ব্যাস্, এটাই হয়ে গেল লুলার প্রচারে তুরুপের তাস। জনমানুষের ত্রাতা হয়ে তিনি ভ্যাকসিনের পক্ষে প্রবল সওয়াল করতে শুরু করলেন। ভ্যক্সিন
সম্রাটের বাজনদাররা যারপরনাই উল্লসিত হয়ে বলসোনারো কে কোভিড কালের ঘাতক এবং দক্ষিণপন্থী বলে দাগিয়ে দিতে শুরু করল।[20]
ক্ষমতায় ফেরার পর তিন মাস অতিক্রান্ত হয়েছে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সরকারি গরীব কল্যাণ কর্মসূচি বোলসা ফ্যামিলিয়া তিনি ফিরিয়ে এনেছেন। লুলার সরকারের একটি ফ্ল্যাগশিপ্ প্রকল্প এই বোলশা ফ্যামিলিয়া। সঠিক অর্থে এটা বিশ্ব ব্যাংকের অনুমোদিত এবং সাহাজ্য-ঋণ নির্ভর একটি প্রকল্প।[21] আমাদের রাজ্যে যেমন নানান শ্রী-যুক্ত প্রকল্প আছে, সেই রকম ব্রাজিলে ছিল বোলশা এস্কুলা( শিক্ষার জন্য অনুদান), বোলশা এলিমেনতোসা( স্বাস্থ্যের জন্য অনুদান) এরকম নানান ধরনের প্রকল্প। ২০০৩ সালে লুলার সরকার এই সব কটি প্রকল্পকে একটি ছাতার তলায় নিয়ে আসে এবং তার নাম দেয় বোলশা ফ্যামিলিয়া। চরম দারিদ্র্যের সীমারেখার নিচে সেখানে তাদের ধরা হয়, যাদের মাসিক আয় ২৮ ডলারের কম। ২০২০ সালের হিসেব অনুযায়ী ব্রাজিলের ন্যূনতম মজুরি ছিল মাসে ১৯০ ডলার।
এই প্রকল্পে পরিবারের প্রধান মহিলা অর্থাৎ সন্তানদের যিনি মা তাকে সামান্য কিছু নগদ অর্থ দেওয়া হয়। তবে শর্ত হচ্ছে সন্তানকে অবশ্যই স্কুলে পাঠাতে হবে এবং টিকা কর্মসূচিতে অংশ নিতে হবে। যদি সন্তানের বয়স ১৬র নিচে হয় তবে সর্বোচ্চ পাঁচটি সন্তানের জন্য তাদের মা পাবেন প্রতি সন্তান পিছু, প্রতিমাসে ১৩ ডলার। সন্তানদের বয়স ১৬ পেরিয়ে গেলে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত সর্বোচ্চ দুটি সন্তানের জন্য মা পাবেন প্রতি সন্তান পিছু প্রতিমাসে ১৫ ডলার।[22] বিশ্ব ব্যাংক বলেছে এই প্রকল্পের তুমুল সাফল্য মেক্সিকো এবং চিলি সহ আরো ২০ টি দেশে তারা প্রয়োগ করতে উদ্যোগী হয়েছে। তাদের মতে এবং অবশ্যই নানান বামপন্থী পত্রপত্রিকার দাবি অনুযায়ী লুলা সরকার নাকি এই প্রকল্পের মাধ্যমে কোটি কোটি ব্রাজিলীয়কে দারিদ্র্যসীমার ওপরে টেনে তুলেছেন।[23] হাস্যকর দাবি সন্দেহ নেই। সমীক্ষায় দেখা গেছে পরিবারগুলি এই অর্থের ৮৭% খরচ করে খাদ্য সামগ্রী কিনতে।[22] অর্থাৎ কোনভাবে দু'মুঠো খেয়ে বেঁচে থাকার রসদ যোগায় এই প্রকল্প। কিন্তু শর্ত আছে। স্কুলে সন্তানদের উপস্থিতির হার কমে গেলে প্রকল্পের টাকা বন্ধ হতে পারে এবং পরপর পাঁচবার উপস্থিতির হার একটি নির্দিষ্ট সীমার নিচে নেমে গেলে এই প্রকল্পের তালিকা থেকে ওই পরিবারটি সম্পূর্ণভাবে বাতিল হয়ে যেতে পারে। স্কুলে উপস্থিতির হার থেকে কোন পরিবার কত টাকা অনুদান পাচ্ছে সেসবের হিসেব-নিকেশ রাখার জন্য ব্যবহার করা হতো স্যাটেলাইট সংযোগ এবং রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে ইন্টারনেটের ব্যবস্থা।[22] যেসব অঞ্চলে বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি কিংবা ইন্টারনেট পরিষেবা নেই সেখানেও মানুষের জীবনের উপর দখলদারির এই বিস্তীর্ণ অন্তর্জাল যাতে অটুট থাকতে পারে, তার জন্যই এই এলাহী ব্যবস্থা। এতে যে বিল এন্ড মেলিনডা গেটস ফাউন্ডেশন সাফল্যের বড়াই করবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তাই, তারা এই প্রকল্পকে দরিদ্রতর দেশগুলোতে নারীর ক্ষমতায়নের প্রবল শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবেই বর্ণনা করেছেন।[24]
তবে নগদ কিন্তু হাতে হাতে মিলবে না। দেওয়া হবে একটি সিটিজেন কার্ড যা আদতে একটি ডেবিট কার্ড। ব্রাজিলের দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতীয় ব্যাংক মারফত লেনদেন হবে এই টাকার।[22]
ভোটের প্রচারের সময় লুলা ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বোলশা ফ্যামিলিয়া প্রকল্পে ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক হতে পারে। সপ্তাহ দুয়েক আগে তিনি প্রকাশ্যে জানিয়েছেন “এখন আর ইতস্তত করার মত সময় নেই। আমরা ভবিষ্যৎ নিয়ে খেলা করতে পারি না। এটা আসলে বিজ্ঞানকে মান্যতা দেওয়ার প্রশ্ন। যদি এমন হয় যে আমাকে ৫০ টা ভ্যাকসিন নিতে হবে কিন্তু মাত্র দশটা ভ্যাকসিন পাওয়া যাচ্ছে তাহলে আমি অবশ্যই যত বেশি সম্ভব, ততগুলো ভ্যাকসিনে নেব। এর কারণ আমরা সবাই বাঁচতে ভালোবাসি। আমার মনে হয় প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে। প্রত্যেকের উচিত তাদের সন্তানদের ভ্যাকসিন দেওয়া”।[25]
গত সপ্তাহে, ব্রাজিলের বহুল প্রচারিত
ইংরেজি দৈনিক দ্য রিও টাইমস পত্রিকায় একটি বড় খবর ছাপা হয়েছিল। শিরোনাম ছিল
Lula says that parents will be forced to vaccinate their children to keep the
government Aid flowing. (Feb 7, 2023)
এই রিপোর্টে বলা হয়েছে, গতকাল রিও
ডি জেনেরিও তে একটি সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল উদ্বোধন করার সময় লুলা বলেছেন, “ বোলসা
ফামিলিয়া ফিরে আসছে, তবে শর্ত আছে। বাচ্চারা যদি স্কুলে না যায় তাহলে তাদের মা এই
সুবিধা পাবে না। প্রত্যেক বাচ্চাকেই ভ্যাকসিন দিতে হবে। যদি তারা ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট
দেখাতে না পারে তাহলে তাদের মা এই প্রকল্পের সাহায্য পাবে না”।[26]
লুলা আরো বলেছেন যে “এই প্রকল্পের
সুবিধা পেতে গেলে প্রত্যেক গর্ভবতী মহিলাকে প্রাক প্রসবকালীন চিকিৎসা নিতেই হবে”। সেক্ষেত্রেও
ভ্যাকসিন বাধ্যতামূলক হবে কিনা কিংবা স্কুলে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে প্রচলিত ভ্যাকসিন এর
সঙ্গে কোভিড ভ্যাকসিনও বাধ্যতামূলক হবে কিনা সে ব্যাপারে কোন স্পষ্টতা নেই। ব্রাজিলের
বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিসিয়া ত্রিনদাদে বলেছেন "ভ্যাকসিন নেওয়া তো শিশুদের
অধিকার। কাজেই বোলশা ফ্যামিলিয়ার টাকা পেতে হলে ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট দেখাতেই হবে”।[26]
মার্কিন প্রশাসন এবং তাবড় কর্পোরেট মাধ্যম লুলার এই প্রকল্পে জয়োধ্বনি দিচ্ছে।[28] ভ্যাকসিনের বিপুল বাজার এবং অতি সস্তার মানব গিনিপিগের সন্ধান পেয়ে তাদের মুখে চওড়া হাসি। কিন্তু খিদে মেটাবার জন্য সামান্য সরকারি ভিক্ষা নেওয়া ছাড়া যেসব হত-দরিদ্র ব্রাজিলীয় মায়েদের সামনে আর কোন রাস্তা খোলা নেই, তারা কি হাসিমুখে সন্তানের জীবনকে বাজি রেখে ভ্যাকসিন কোম্পানি ও তাদের বিশ্বস্ত রাষ্ট্র-নেতা লুলা’র কাছে আজীবন নতজানু হয়ে থাকবেন এবং বলবেন ভিভা লুলা ! ভিভা লুলা! ?
কারোর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং তার সম্মতি ব্যতিরেকে কোন চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায় না কারণ নিজের দেহের ওপর আমাদের অধিকার কোন পরিস্থিতিতেই খর্ব করা যায় না। নুরেমবার্গ কোড, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদ এবং ইউনেস্কোর চিকিৎসা সংক্রান্ত মানব অধিকারের প্রস্তাবনায় এই কথাই বলা রয়েছে।[29] এখন প্রশ্ন হচ্ছে বৃহৎ কর্পোরেটদের স্বার্থে লুলা’য়িত বামপন্থা কি এই মৌলিক অধিকার হনন করতে চায়?
তথ্যসুত্রঃ
3. https://monthlyreview.org/2020/06/01/the-brazilian-crisis-and-the-new-authoritarianism/
7. https://time.com/6226932/lula-win-amazon-climate-change-brazil/
11. https://www.wsj.com/articles/biden-and-da-silva-aim-to-rekindle-u-s-brazil-relations-3213cc23
12. https://www.ft.com/content/96eac94a-908b-4d87-b09a-c7adc0f002d6
14. https://amazonwatch.org/news/2022/0222-complicity-in-destruction-iv
15. https://www.reuters.com/world/americas/lulas-promise-ministry-indigenous-people-doubt-2022-12-05/
16. https://www.amazonfund.gov.br/en/amazon-fund/
17. https://www.theguardian.com/world/2021/mar/10/brazil-lula-comeback-speech-bolsonaro-covid-response
20. https://www.theguardian.com/global-development/2021/jun/29/brazil-coronavirus-deaths-jair-bolsonaro
21. https://www.worldbank.org/en/news/feature/2010/05/27/br-bolsa-familia
22. https://en.wikipedia.org/wiki/Bolsa_Fam%C3%ADlia
23. https://www.economist.com/the-americas/2008/02/07/happy-families
24. https://www.gatesfoundation.org/equal-is-greater/case-study/brazil/
27. https://www.newsclick.in/bazil-lula-remergees-very-different-political-world
29. https://unesdoc.unesco.org/ark:/48223/pf0000212116
-
গৌতম দাস
প্রাবন্ধিক এবং জন-স্বাস্থ্য গবেষক
মতামত পাঠান ঃ eopener040@gmail.com
এই সম্পর্কিত বিষয়ে অনান্য লিঙ্কঃ https://www.globalresearch.ca/president-lula-is-a-fellow-traveler-firmly-aligned-with-u-s-strategic-interests/5808961
----------------------------------শেষ--------------------------------
The Eye-opener is a blog that questions dominant narrative
চলতি আখ্যানকে প্রশ্ন করার জন্যই এই ব্লগ দ্য আই-ওপেনার
We like to
question & be questioned
প্রশ্নের আড়াল নয়, প্রশ্নের মুখোমুখি
send your
write-up, comment or question
লিখুন, মতামত দিন, প্রশ্ন করুন
eopener040@gmail.com
একটা আশ্চর্য ঘটনা দেখছি , বামপন্থীদের জয় এ দক্ষিণপন্থীগণ চরম খুশি ! আর এর থেকেও আশ্চর্য ঘটনা, যে সব বামপন্থী অত্যন্ত শিক্ষিত , নানা বিষয়ে সুক্ষ বিচার করেন, দক্ষিনপন্থীদের শয়তানি ধরে ফেলেন, তাদের চোখে এটা একেবারেই ধরা পড়ছেনা |
ReplyDeleteযে কোনো টেকনোলজি র ভালো ও খারাপ দিক থাকে | আগুন আবিষ্কার করে কত পুড়ে মারা গেছে , গাড়ি আবিষ্কার করে কত গাড়িচাপা পরে ও মারা গেছে| সেইরকম, টিকার ও আছে| টিকার লাভ ক্ষতি বিচার না করেই শিশুদেহে ব্যাপক হারে প্রয়োগ করছে | শিশু দের কনসেন্ট এর ব্যাপার ই নেই | টিকার ক্ষতির দিকটা ও এদের চোখে ধরা পড়েনা |
এইরকম জটিল রকমের কানা , ভারী আশ্চর্য , তাইনা ?
লেখাটি যথার্থ eye opener | লেখক বার বার বলেন , পরে দেখুন, সিদ্ধান্ত আপনার | আমিও বলি, নিজের শিক্ষা , বুদ্ধি , যুক্তির ওপরে ভরসা করে , এই সমস্ত লেখা পরে , নিজেই বিচার করুন \
ReplyDeleteহ্যাঁ, লুলার জয়ে মাথামুণ্ডু কিছু না বোঝা বাম সমর্থক দের উচ্ছাস দেখে বিরক্ত লাগছিলো। তখনই এরকম কিছু ঘটবে বলে আন্দাজ করেছিলাম। চিলির ক্ষেত্রেও তো একই জিনিস হল।
ReplyDeleteexactly !
Delete